রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অচলাবস্থা



সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অচলাবস্থা


দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নিয়মিত নিয়োগের বাইরে প্রায় ৪৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগের দাবি উঠলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তা মানেনি। এখন হাইকোর্ট দুই মাসের মধ্যে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিতে বলেছেন।

এদিকে প্রায় ৪০ হাজার নিয়মিত পদ এখন শূন্য। এর মধ্যে ১৫ হাজার পদের বিপরীতে দরখাস্ত আহ্বান করা হলেও আদালত এই নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ১০ হাজার প্যানেলভুক্ত শিক্ষক নিয়োগে উচ্চ আদালতের নির্দেশ পেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনি চাপ ও বাস্তব কিছু সমস্যার মুখে পড়েছে। প্রায় ৪৮ হাজার প্যানেলভুক্ত প্রার্থী ও পুলভুক্ত শিক্ষকেরা পরে এই আদেশের সুফল পেতে পারেন বলে আইনজীবী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই ধারণা করছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, প্যানেলভুক্ত শিক্ষকদের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। অন্যদিকে পুলভুক্ত শিক্ষকদের মামলা চললেও রায় সরকারের পক্ষে আসবে বলে তাঁরা মনে করছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, খণ্ডকালীন শিক্ষকের মতো তাঁদের নেওয়া হলেও কাজ করানো হয়নি। তা ছাড়া, পুলভুক্ত শিক্ষকেরা চাকরি স্থায়ী করার দাবি করতে পারবেন না বলে শর্ত ছিল।
প্রায় তিন-চার বছর ধরে এই দুই ধরনের শিক্ষক নিয়ে জটিলতা ও আইনি যুদ্ধ চলছে। পুলভুক্ত শিক্ষকদের মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত এক বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য ১০ মাস আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই পুলভুক্ত শিক্ষকদের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য প্রায় ১০ লাখ প্রার্থী টেলিটকের মাধ্যমে আবেদন করেছিলেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া এসব পদ যেমন শূন্য থাকছে, তেমনি নতুন প্রায় পাঁচ হাজার পদ গত এক বছরে শূন্য হয়ে পড়েছে, যা বাড়তেই থাকবে। শিক্ষকস্বল্পতায় অনেক বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও বলেছেন, দেশে এমনিতে শিক্ষকসংকট রয়েছে। তার ওপর এসব জটিলতায় লেখাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে।
এর আগে আপিল বিভাগ প্যানেলভুক্তদের নিয়োগের জন্য রায় দিলেও মন্ত্রণালয় তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে। প্যানেলভুক্তদের পক্ষে রায় হওয়ায় এখন নিয়োগ দেওয়া ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সামনে আর পথ নেই।
তবে সে ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বাস্তব কিছু সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কোটা মেনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে হয়। এখন নারী কোটা ৬০ শতাংশ, পোষ্য কোটা ২০ শতাংশ এবং পুরুষ কোটা ২০ শতাংশ। এসব কোটার মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটা রয়েছে।
প্যানেলভুক্ত প্রার্থী ও পুলভুক্ত শিক্ষকদের নিতে হলে এসব কোটা মেলানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়বে। এসব প্রার্থীর অনেকেরই যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল। প্রচলিত নিয়মে প্রাথমিক শিক্ষকদের যেভাবে মেধা যাচাই করে নেওয়া হয়, এসব নিয়োগে তা অনেকটাই শিথিল ছিল। তা ছাড়া প্রায় ৪৮ হাজার প্রার্থী নেওয়ার মতো পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতা, পূর্বাপর না ভেবে প্রার্থীদের প্যানেল করা ও পুল গঠন করে শিক্ষক নেওয়া এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও শিক্ষকেরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হয়ে থাকেন। কখনো তাঁরা রাজপথে যান, কখনো আইনের আশ্রয় নেন।
তবে রাশেদা কে চৌধূরী মনে করেন, আদালতের নির্দেশ অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু শিক্ষকদের মানের সঙ্গে যাতে আপস না করা হয় এবং এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

জাতীয়করণের ঘোষণার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি: ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন, যা তিন ধাপে বাস্তবায়নের কথা।
প্রথম ধাপে ২২ হাজার ৯৮১টি বিদ্যালয় সরকারি হয়। প্রতি বিদ্যালয়ে পাঁচজন করে মোট পদের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৯০৫টি। নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরতদের মধ্য থেকে প্রায় ৯৩ হাজার পদ আত্তীকৃত করা হয়েছে। এখনো ওই ধাপে ২২ হাজার পদ শূন্য আছে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৭১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। এগুলোর মোট ৮ হাজার ৫৯৫ জন শিক্ষককে জাতীয়করণ করার কথা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ-সংক্রান্ত ফাইল চালাচালি চলছে প্রায় দুই বছর। ফলে বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষকেরা। সর্বশেষ জনপ্রশাসন থেকে এ-সংক্রান্ত ফাইল গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে তৃতীয় ধাপে আরও প্রায় দেড় হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাড়ে সাত হাজার পদ সৃষ্টি করা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে যেসব পদ সৃষ্টি করা হবে, সেগুলোর বিপরীতে ইতিমধ্যে শিক্ষকেরা আগে থেকেই কর্মরত আছেন। তাই সেখানে প্যানেলভুক্ত শিক্ষকদের নেওয়ার সুযোগ তেমন নেই।

প্যানেলভুক্তদের নিয়োগ যখন শুরু: রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নিয়ে ৪২ হাজার ৬১১ জনকে প্যানেলভুক্ত করা হয়। এঁদের প্রায় ১৪ হাজার প্রার্থী নিয়োগ পান।
২০১৩ সালে এসব বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা হওয়ায় বাকি সাড়ে ২৮ হাজার প্রার্থীর নিয়োগ বন্ধ করে মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে আইনের আশ্রয় নিলে গত মে মাসে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ১০ রিট আবেদনকারীকে নিয়োগের নির্দেশ দেন।
আইনি যুদ্ধ চলার একপর্যায়ে প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের দুই মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের করা ৩৬৭টি রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।
রিট আবেদনকারী পক্ষের একাধিক আইনজীবী বলেছেন, ৩৬৭টি রিটে বাদী হিসেবে প্রায় ১০ হাজার নিয়োগপ্রত্যাশী রয়েছেন। এই রায় কার্যকর হলে বাকি ১৮ হাজার প্যানেলভুক্ত শিক্ষকও এর সুবিধা পাবেন।
খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল ও সাতক্ষীরার ১১২ জন প্যানেলভুক্ত শিক্ষকের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করেন ঢাকায় অবস্থানরত যুবক কাজী মতিনুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আদালতের এই মানবিক সিদ্ধান্ত সরকারের দ্রুত কার্যকর করা উচিত।
আদালতে ২৯টি রিট আবেদনকারী আইনজীবী মো. ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মোট ৩৬৭টি রিটে নিয়োগপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো হতে পারে।

পুলের শিক্ষক আটকে দিল সরাসরি নিয়োগ: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষকদের ছুটিজনিত শূন্যপদে ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করতে শিক্ষক পুল গঠন করে মন্ত্রণালয়। প্রার্থীদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার এবং মাসে সম্মানী ভাতা নির্ধারণ করে ছয় হাজার টাকা।
প্রাথমিক শিক্ষক পুল নীতিমালা, ২০১৪ অনুযায়ী উপজেলা-থানা পর্যায়ে পুল গঠন করা হয়। নিয়োগবিধিতে নির্ধারিত যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে ন্যাশনাল সার্ভিসের সদস্যদেরও এই পুলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে বলা হয়, পুলে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা সারা দেশে সর্বোচ্চ ২০ হাজারের মধ্যে থাকতে হবে।
পুলভুক্ত শিক্ষকদের নিযুক্তির সময় ১৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে পাঁচটি শর্তে একটি চুক্তিতে সই করতে হয়। এর একটি ছিল, এই নিয়োগ নিয়মিত হবে না এবং এটি স্থায়ী হওয়ার নিশ্চয়তা দেবে না।
কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে পুলের শিক্ষকেরা আইনের আশ্রয় নেন। তাঁরা আগে তাঁদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান। হাইকোর্ট শিক্ষক নিয়োগের ওপর স্থগিত আদেশ দেন, যা এখনো বহাল আছে।
প্যানেলভুক্ত শিক্ষকেরা আদালতের রায় পাওয়ার পর পুলভুক্ত শিক্ষকেরাও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। এ পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় অসহায় অবস্থার মুখে পড়েছে।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত নির্দেশ দেওয়ার পর এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ (অপেক্ষা এবং দেখা) ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে মন্ত্রণালয় এসব মামলা ঠিকভাবে মোকাবিলা করেনি। তারপরও দেখা যাক ৬০ দিন সময় আছে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে করণীয় ঠিক করা হবে।

সূত্রঃ প্রথম আলো

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন